ডাবল ভাউচার, সিগনেচার কার্ড ও বিগ বিলিয়ন রিটার্নস—এ রকম চটকদার অফারে অস্বাভাবিক মূল্যছাড়ের ফাঁদে ফেলে হাজার হাজার গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করছে কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বাস্তবে এদের কেউ কেউ মাত্র ১০ শতাংশ গ্রাহকের অর্ডার করা পণ্য সরবরাহ করে, বাকি গ্রাহকের পণ্য সরবরাহে গড়িমসি করে টাকা আত্মসাৎ করে। আবার কেউ কেউ ই-কমার্সের নামে নিষিদ্ধ এমএলএম ব্যবসা চালাচ্ছে। গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের পর প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কেউ কেউ দেশত্যাগ করছেন, বিদেশে পাচার করছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।

ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ আলোচিত ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তদন্ত করে এমন অভিযোগ পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই ইউনিটের সাইবার পুলিশ সেন্টার মামলার পাশাপাশি সাইবার অপরাধ হিসেবে ই-কমার্স সাইটে নজরদারি শুরু করেছে। ধামাকা শপিং ডটকম নামের একটি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে ৫০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলেও তথ্য পেয়েছে সিআইডি। সর্বশেষ ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গতকাল মঙ্গলবার এক হাজার ১০০ কোটি টাকা প্রতারণার মামলা করেছেন ভুক্তভোগী এক গ্রাহক।

সাইবার তদন্তকারীরা বলছেন, অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকটি ছোট প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের গ্রেপ্তারের পর ই-কমার্সের প্রতারণা সামনে আসতে থাকে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও শত শত গ্রাহক অভিযোগ করছেন। এ কারণে নজরদারির আওতায় নেওয়া হয়েছে ১৪টি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো—ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, ধামাকা শপিং ডটকম, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপ, আলেশা মার্ট, কিউ-ডটকম, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, এসকে ট্রেডার্স ও মোটরস। এরই মধ্যে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি), ব্র্যাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ঢাকা ব্যাংক ১০টি প্রতিষ্ঠানে অনলাইন মার্চেন্টে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের লেনদেন স্থগিত করেছে।

এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—ইভ্যালি, আলেশা মার্ট, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদিনের প্রদীপ, বুমবুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস ডটকম বিডি। সূত্র জানায়, এরই মধ্যে তথ্য মিলেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের টাকা নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যাচ্ছে না। পণ্য বিক্রির টাকা সরাসরি চলে যাচ্ছে বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টে। ধামাকা শপিং ডটকম গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া ৫০ কোটি টাকা অন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিয়ে পাচার করেছে। অগ্রিম টাকা ‘ইনভ্যারিয়েন্ট টেলিকম’ নামে খোলা একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করেছে ধামাকা।

সেখানে আট মাসে ৫৮৮ কোটি টাকা লেনদেন হলেও বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৯৩ হাজার টাকা। এটিসহ সংশ্লিষ্ট ১৪টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে, যার মধ্যে এমডি জসীম উদ্দিনের পাঁচটি, ইনভ্যারিয়েন্ট টেলিকমের সাতটি, মাইক্রো ট্রেডের একটি ও মাইক্রো ফুড অ্যান্ড বেভারেজের একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। জসীম উদ্দিন বিদেশে থাকায় জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। তাঁকে বেশ কয়েকবার ডাকা হলেও ‘করোনার কারণে দেশে ফিরতে পারছেন না’ জানিয়ে এড়িয়ে গেছেন তিনি। ধামাকার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের আলাদা মামলা হবে বলে জানায় সূত্র। ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও এমডি মো. রাসেলের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।

এর আগে ১২ জুলাই নিরাপদ ডটকম নামের প্রতিষ্ঠানের পরিচালক শাহরিয়ার খানকে গ্রেপ্তার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্ধেক দামে পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণার অভিযোগ পেয়েছে সিআইডিও। ডিবির উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু গ্রাহককে পণ্য দিয়ে সেটির রিভিউ দেখিয়ে প্রতারণা করে নিরাপদের শাহরিয়ার খান।’ আদিয়ান মার্ট থেকে পণ্য কিনতে অর্ডার দিয়ে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন গ্রাহক। সূত্র মতে, অভিযোগ পাওয়ায় ১৪টি প্রতিষ্ঠানের লেনদেন খতিয়ে দেখছেন সিআইডির তদন্তকারীরা।

এরই মধ্যে প্রতারণা এবং হয়রানির অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। মানি লন্ডারিং অনুসন্ধান হবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। জানতে চাইলে অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সাইবার স্পেস ব্যবহার করে কাস্টমারের সঙ্গে যে প্রতারণা করছে, এমন ব্যাপারে ছায়া তদন্ত করছে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার। বেশ কয়েকটি ই-কমার্স সাইটের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ছদ্মবেশী ফর্মে মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছে। আর্থিক নীতিমালা অনুযায়ী কোনো অবস্থায়ই তারা এটা করতে পারে না। আমরা তদন্ত করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করব।